চট্টগ্রাম নগরে ৪ হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজির ভয়ঙ্কর সিলিন্ডার বোমা, পুলিশের মাসিক বাণিজ্য ৬৫ লাখ টাকা

Jahangir Alam babu    |    ১২:২৩ পিএম, ২০২০-০৮-১২


চট্টগ্রাম নগরে ৪ হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজির ভয়ঙ্কর সিলিন্ডার বোমা, পুলিশের মাসিক বাণিজ্য ৬৫ লাখ টাকা

জাহাঙ্গীর আলম বাবু:  ২০০৪ সালে তৈরীকৃত ৩৬১৬ টি সিএনজি অটোরিকশা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদদোত্তীর্ণ হয়েছে। এই অটোরিকশা গুলো এখনও চলছে চট্টগ্রাম নগরীতে একই সঙ্গে এই গাড়ী গুলোর রয়েছে গতির দুর্গতি এবং দুর্গতির গতি। রয়েছে ভয়ঙ্কর সিলিন্ডার বোমা। ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে চালক, মালিকরা বাধ্য করছে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ী চালাতে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক পুলিশ কামিয়ে নিচ্ছে প্রতিমাসে ৬৫ লাখ টাকা। বিআরটিএ চিঠি চালাচালি শেষে হয়ে আছে ঠুঁটো জগন্নাথ! এই অবস্থায় যাত্রীদের পকেট তো কাটা পড়ছেই, ভোগান্তি ও বিবাদেরও শেষ হচ্ছে না। সিএনজি অটোরিক্সা মালিক সমিতি বিআরটিএকে বারবার তাগাদা দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশা বিআরটিএ নিবন্ধন দিয়েছেল ২০০১ সাল থেকে। ইতিমধ্যে ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ মডেলে যে সকল অটোরিকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল এমন সাড়ে ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ইতিপূর্বে স্ক্রাপকরণ শেষ করেছে চট্টগ্রাম বিআরটিএ। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে প্রস্তুতকৃত ৩৬১৬ টি সিএনজি অটোরিকশা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। তারপরও সেগুলো মহানগরীতে চলছে ও ভাড়া নিচ্ছে। এই সব অটোরিকশায় মেয়াদের অনুপাতে ভাড়ার হিসাব করা হলেও, সেই ভাড়া মালিকেরা মানেন না। মালিকদের লম্বা হাত যাত্রীদের পকেট কেটেই চলেছে! চালক দেয় মালিককে দেওয়া জমার দোহাই, মালিক দেখায় রক্ষণাবেক্ষণের খরচের অজুহাত। অথচ যাত্রীদের অভিযোগ শোনার কেউই নেই!

এমন অভিযোগ করে চলতি বছরের ৬ জুলাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে আবেদন করেছেন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সিএনজি থ্র্রি-হুইলার বেবিট্যাকসি মালিক সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি নুরুল হুদা বাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক ওয়াজি উল্লাহ স্বাক্ষরিত একচিঠিতে সংগঠনটি বলছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর চলাচলকারী ২০০৪ মডেলের ৩,৬১৬ টি সিএনজি অটোরিক্সা আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) গতবছরের (২০১৯ সাল) ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারী থেকে এইসব সিএনজি অটোরিক্সা সড়কে চলাচল সড়ক পরিবহন আইনে সম্পূর্ণ অবৈধ। এই অবস্থায় এইসব গাড়ির ডুকুমেন্ট এর মেয়াদ না থাকার অজুহাতে চট্টগ্রাম নগর ট্রাফিক পুলিশ সড়ক আইনে বেপরোয়া মামলা দিচ্ছে। এবং বিপুল অংকের জরিমানা আদায় করছে। অন্যদিকে মামলা ও হয়রানী না করার শর্তে গাড়িপ্রতি ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মান্থলির নামে ঘুষ প্রদান করতে হচ্ছে। 

তবে সংগঠনটির এই শীর্ষনেতাদের দাবী বিদ্যমান এ সংক্রান্ত সার্ভিস রুলস অনুয়ায়ী গত ১ জানুয়ারী থেকে সিএনজি অটোরিক্সা গুলো স্ক্রাপকরণ ও প্রতিষ্ঠাপন বাধ্যবাধকতার সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে অভাবিত নিষ্ক্রিয় ও দায়িত্বহীন ভুমিকা পালন করছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর ট্রাফিক পুলিশ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতি মাসে ৬৫ লাখ টাকা। বিআরটিএ সংঘটিত এই ঘৃণ্য অনৈতিক কর্মকান্ডর দায় এড়াতে পারে না বলেও আবেদনে এই শীর্ষনেতারা দাবী করেন।

এইদিকে বিআরটিএ চট্টমেট্রো-০১ সার্কেলের সূত্রে জানা যায় সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারী সহকারী পরিচালকের স্বাক্ষরীত একটি চিঠি বিআরটিএর সদর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। উক্ত চিঠিতে ২০০২ সালের ৯৫টি, ২০০৩ সালের ৪৪ টি এবং ২০০৪ মডেলে প্রস্তুতকৃত ৩৬১৬ টি মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি/পেট্রোলচালিত ৪ স্টোক থ্রি-হুইলার অটোরিকশা স্ক্রাপকরণ জন্য নির্দেশনা চেয়েছে এই সার্কেলের সহকারী পরিচালক।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চট্টমেট্রো-১ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) তৌহিদুল হোসেন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা নিদিষ্ট সময়ে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ীগুলোর  স্ক্রাপকরনের নির্দেশনার জন্য বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্দেশনা আসবে। নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথে এই সিএনজি অটোরিকশা গুলো স্ক্রাপকরণের কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তৌহিদুল হোসেন।

সিএনজি অটোরিক্সা স্ক্রাপকরণের বিষয়ে প্যাসেঞ্জার ভযেসকে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি অটোরিক্সা গুলো স্ক্রাপকরণ ও প্রতিস্থাপনের জন্য অনুমতি চেয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ে আবেদন পাঠিয়েছি। স্থাস্থবিধি রক্ষা ও করোনার মহামারির কারনে এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে মন্ত্রনালয় থেকে কোন অনুমতি প্রদান করা হয়নি। অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে এই গাড়িগুলো স্ক্রাপ করণ ও প্রতিস্থাপনের কাজ শেষ করা হবে।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী এই সব সিএনজি অটোরিকশা নিবন্ধনের সময় মেয়াদ বা আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ বছর। পরে মালিক ও চালকদের দাবির মুখে তিন দফায় অটোরিকশাগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। ১৫ বছরের মেয়াদ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। বর্তমানে সিএনজি অটোরিকশা গুলো লক্কর-ঝক্কর ও চলাচলের অনুপযোগী এবং রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারবোমা।

এই সব ঝুঁকিপূর্ণ সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডারবোমার আঘাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল কয়েকজন যাত্রী ও চালককে। ২০১৭ সালের ৯ মার্চ নগরীর সোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় ইঞ্জিনে অতিরিক্ত তাপের কারণে একটি সিএনজি অটোরিকশায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের ২৪ জুন নগরীর বেবি সুপার মার্কেটের সামনে একটি চলন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, এতে চালকসহ তিনজন নিহত হন। এই সব মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারবোমা যুক্ত ৩৬১৬ টি সিএনজি অটোরিকশা নগরীতে যাত্রী বহন করে চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে এসব সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ সর্বনাশ। এটা যে অমূলক নয় তা কয়েকটি উদাহরণে পরিষ্কার। সর্বশেষ, ২০১৮ সালে নগরীর চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাটের এক কিলোমিটার এলাকায় সিএনজিচালিত  অটোরিকশায় সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাঁচজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন।

এই বিষয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সিএনজি থ্রি-হুইলার বেবিট্যাকসি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়াজি উল্লাহ বলেন, সিএনজি অটোরিক্শার আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সাথে সাথে বিআরটিএ এই গাড়ীগুলো স্ক্রাপকরণ করার দরকার ছিল। তবে বিআরটিএ এই কাজটি এখনও শুরুও করেনি। এই কারনে ঝুঁকিপূর্ণ এই সিএনজি অটোরিক্সাগুলো এক শ্রেণীর ট্রাফিক পুলিশকে মাসিক “মান্থলি” মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে সড়কে চলাচল করছে। 

এই বিষয়ে প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সদস্য সচিব মো. ফারুক হোসেন বলেন, ২০১৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রামে আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে ২৬ হাজার লক্কর-ঝক্কর সিএনজি অটোরিক্সা প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। তার মধ্যে চট্টগ্রামে ১৩ হাজার। ২০০২ ও ২০০৩ এর মডেলের সিএনজির স্ক্রাপ কার্যক্রম সঠিক সময়ে করা হলেও ২০০৪ এর মডেল ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৯এ মেয়াদকাল শেষ হলেও এখন পর্যন্ত স্ক্রাপ কার্যক্রম শুরু হয়নি যা দুঃখজনক। আমাদের চালকরা ঝুকি নিয়ে এই লক্কর-ঝক্কর গাড়ী চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এবং সড়কেও বিভিন্ন হয়রানীর শিকার হচ্ছে। লক্কর-ঝক্কর গাড়ী হওয়ায় যাত্রী এইসব সিএনজি অটোরিকশায় উঠতে অনিহা প্রকাশ করে যার ফলে চালকের দৈনিক আয় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। 

এই বিষয়ে বাংলাদেশ অটোরিক্সা শ্রমিক লীগের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ওসমানগনি প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, ২০০৪ মডেলের এই গাড়ি গুলো বর্তমানে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু চালকরা পেটের দায়ে গাড়িগুলো চালাতে হচ্ছে। এই গাড়িগুলো যেখানে সেখানে চলন্ত অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায়, ইঞ্জিল নষ্ট হয়ে যায়। তবে তিনি মনে করেন এই গাড়ি গুলোতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এবং কোন ব্যক্তি মারাগেলে, দায়িত্ব অবহেলার কারনে বিআরটিএকে এর দায়দায়িত্ব নিতে হবে।